ডেড রেকনিং: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি (ইংরেজি: Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War) শর্মিলা বসু রচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক বিতর্কিত একটি বই।[১]
বইটি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে। লেখক তার নিজস্ব গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে বইটি রচনা করেছেন। যুদ্ধকালে মানবিক বিপর্যয়ের দিকটি তিনি উপস্থাপন তুলেছেন। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
বইটিতে তিনি দাবি করেছেন যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়ে থাকে তা অনেকাংশে অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থেই এই অতিরঞ্জন বলে তিনি দাবি করেছেন।[২][৩][৪] পাকিস্তানিদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এর পাকিস্তানিদের চালানো গনহত্যার সমালোচনা করে বই লিখেছেন, তাদের বর্ণনাকে বসু ‘সীমাবদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছেন।[৫] যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের বর্ণনার সাথে পাকিস্তানিদের বর্ণনার অমিল রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বসু পাকিস্তানিদের বর্ণনাকে বাংলাদেশীদের বর্ণনা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করেছেন।[৬] যেসব বিদেশী সংবাদ প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাদের ব্যপারে বসু বলেছেন, “বিদেশী সংবাদ প্রতিবেদন সবসময় সুষমভাবে নির্ভরযোগ্য নয়”।[৭]
গণহত্যা ও লুন্ঠন
তিনি কিছুসংখ্যক বাছাইকৃত[৮][৯] প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে সেই আলোকে তার মতামত তুলে ধরেছেন বলে সমালোচিত হয়েছেন।[৮][৯] তিনি দাবি করেছেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়েই হত্যা ও নিষ্ঠুরতার অপরাধে অপরাধী। মুক্তিবাহিনী ও তার ভাষায় ‘উগ্রপন্থী বাঙালী জাতীয়তাবাদী’রা নৃশংসভাবে অবাঙালী বিহারিদের হত্যা ও সম্পদ লুন্ঠন করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। এক্ষেত্রে নির্বিচারে নিরপরাধ অরাজনৈতিক অবাঙালী (বিহারি নামে পরিচিত) পুরুষ, নারী ও শিশুরা হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে তিনি লিখেছেন। অপরপক্ষে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অনেক স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হত্যার শিকার বলে তিনি লিখেছেন। তবে তার মতে, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদেরকে রেহাই দিয়ে শুধুমাত্র সমর্থ পুরুষদেরকেই হত্যা করা ছিল পাক সেনাদের রীতি। অবশ্য সামান্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী বা শিশুরা নিহত হয়েছিলেন বলে তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানিদের সহযোগী বাঙালী রাজাকার কর্তৃক অনেক হত্যা ও লুঠ হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। অনেক এলাকায় মুসলিম জনগণের দ্বারা হিন্দুদের সম্পদ লুঠের ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি লিখেছেন। অনেক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা মানবিক আচরণ প্রদর্শন করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে অনেক স্থানে বিহারিদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি লিখেছেন। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ খুলনায় নিউ টাউন কলোনিতে ব্যাপক বিহারি হত্যা করা হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন[১০]।
তবে তার মতে, পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক যে হত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে তাকে জাতিসংঘ প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে ‘গণহত্যা’ বা genocide বলা যাবে না। এ ব্যাপারে তিনি তার যুক্তিগুলো বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে তার প্রধান যুক্তি ছিল যে, পাক সেনারা বেছে বেছে শুধুমাত্র/যথাসম্ভব ‘যুদ্ধমান শত্রু’দেরকেই হত্যা করেছিল; শুধুমাত্র বাঙালী হবার কারণে কাউকে হত্যা করা হয়নি। তবে বিহারিদের বিরুদ্ধে যে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে সেটাকে গণহত্যা বলা যায়; কারণ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, যুদ্ধমান, অযুদ্ধমান নির্বিশেষে জাতিগত কারণেই এদেরকে হত্যা করা হয়েছিল এবং তা সংঘটিত হয়েছিল তার ভাষায় উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালীদের দ্বারাই। তিনি আরো লিখেছেন, একাত্তুরে পাক বাহিনী কর্তৃক হিন্দু হত্যাগুলোকেও গণহত্যার সংজ্ঞায় ফেলা যায়, কারণ এতে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই তাদেরকে ‘যুদ্ধমান শত্রু’ বলে গণ্য করা হয়েছিল[১১]।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পূর্বে সংঘটিত ‘স্বাধীনতাকামী’ বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি মত প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, এই অন্যায় হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার সম্ভাবনা কম; বরং পাকিস্তানপন্থী বাঙালি আল-বদর বাহিনীর দ্বারাই এটি সংঘটিত হয়েছে বলে বেশি যুক্তি পাওয়া যায় [১২]। প্রত্যক্ষদর্শী ও নিকটাত্মীয়দের সাক্ষাৎকার গ্রহণপূর্বক তিনি বইটিতে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, সেই বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করার পর লাশ বিকৃত করা হয়নি, যেমনটি বাংলাদেশে সাধারণভাবে বিশ্বাস ও প্রচার করা হয়ে থাকে [১৩]।
তিনি আরো অভিযোগ তোলেন যে, যুদ্ধে বিজয়ের পর বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ‘পাকিস্তান সমর্থক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদেরকে নৃশংসভাবে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল ১৯৭১ সালের ১৯-২০ ডিসেম্বর [১৪]।
যুদ্ধের ফলাফল স্বরূপ অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিকাশ
বইটিতে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও রাজনৈতিক হানাহানির ফলে যে জাতিগত ও রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো বহাল আছে এবং এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে এখনো প্রবল রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে। বইটির ১৮২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এক সাগর সহিংসতার স্মৃতি রেখে গেছে; যেখানে দেখা গেছে ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভীতি প্রদর্শন, পাশবিকতা ও ‘নির্মূল করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা’ করার উদগ্র সংস্কৃতি।
যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা
বইটিতে লেখক যুক্তি ও বিশ্লেষণ প্রদর্শন পূর্বক মতামত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাকুল্যে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে; এবং এই সংখ্যা বাঙালী, বিহারী ও পাকিস্তানি সব মিলিয়ে। ত্রিশ লাখ বাঙালী নিহত হয়েছেন বলে যে মত বাংলাদেশে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেছেন[১৫]।
তিনি উল্লেখ করেন, নিহতের সংখ্যার অতিরঞ্জন নিতান্তই ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং তা প্রকৃত নিহতদের প্রতি ‘বিদ্রুপ’ করার শামিল।
বোসের বইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এ নিহতের ঘটনা নিয়ে তিনটি সংখ্যা আছেঃ পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার তাজের মতে সংখ্যা ৪৪, অন্যদিকে অপারেশন-এর দায়িত্বে থাকা লেঃ কর্নেল বাসারাত-এর রেকর্ডকৃত বার্তায় নিহতের সংখ্যা ৩০০। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ নিহত ১৪৯ জনের নামে স্মৃতিফলক রয়েছে। বোসের মতে, যেহেতু মৃতদেহ কবর থেকে তুলে গণনা করা হয়নি, তাই দুইপক্ষই নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলতে পারে। সমালোচকরা পুরো বইজুড়ে বোসের এই দৃষ্টিভংগীকে ‘সমস্যাযুক্ত’ বলেছেন।[১৬]
ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি
বসু তার প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার তাজের সাক্ষ্যকে সত্য ধরে দাবি করেন রাজারবাগে কোন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। পরে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন যে, তাজ সামরিক অভিযানের প্রথম রাতে উপস্থিত ছিলেন না। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা ধর্ষণ-এর নির্মম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর বর্ণনাকে বসু বাতিল করে দিয়েছেন, সাক্ষী অশিক্ষিত এই যুক্তিতে। অন্যত্র ধর্ষন-এর শিকার একজন নারী প্রাণ হারানোর ভয় করছিলেন দেখে বসু দাবি করেছেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় নিজেকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এসব কারণে বই প্রকাশের আগে থেকেই গবেষণার পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য বসু সমালোচিত হয়ে আসছিলেন।[১৭]
সমালোচনা ও প্রশংসা
তার বইটি বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।[৮] পাকিস্তানে বসুর বইটি কোন মহলে প্রশংসিত আর কোন মহলে সমালোচিত হয়েছে।[১৮] ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকরাও বসুর লেখা ইতিহাসের সমালোচনা করেছেন।[১৯] পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অনেকেই বইটির সমালোচনা করেছেন।[৭] বইটিতে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতযুক্ত ভাষা ব্যবহারের কারণেও বসু সমালোচিত হয়েছেন, তিনি বাংলাদেশীদের যুদ্ধকালীন বিবরণগুলিকে “দাবি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানিদের বিবরণ গুলিকে “বিবরণ” হিসেবেই দেখিয়েছেন।[২০] কেউ কেউ তার গবেষণা পদ্ধতি সঠিক নয় বলেও দাবি করেছেন।[৯][১৯][২১][২২]
বোস পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজীর উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন, যদিও অন্য পাকিস্তানি জেনারেলরা এর সাথে ভিন্নমত পোষন করেন। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এফ বি আলীর ভাষ্যমতে, নিয়াজী একজন প্রতারক, লম্পট এবং কাপুরূষ। করাচিতে নিয়াজীর গাড়ি সবসময় নিষিদ্ধ পল্লির বাইরে পাওয়া যেত।[১৯] আরেকজন পাকিস্তানি জেনারেল খাদিম হুসেন রাজার মতে, পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী বাঙ্গালী নারীদের উপরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।[২৩] লিপিবদ্ধ ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণকে নিয়াজির দাবির প্রেক্ষিতে ৩৪,০০০ দেখানোতে ইতিহাসবিদরা শর্মিলা ইচ্ছাকৃতভাবে সংখ্যা নিয়ে খেলা করছেন কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন।[২৪] বোসের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তানে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির সমর্থক।[৬][৮][১৬][১৮][২৫]
অন্যদিকে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি শর্মিলা বসুর উক্ত বইটি অনেক প্রশংসিতও হয়। দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে এই বইটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা বলে উল্লেখ করা হয়।[২৬] দ্যা হিন্দু পত্রিকায় বলা হয় বইটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি নৈতিক সমতা তৈরি করে।[২৭] অতুল মিশ্র একজন সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ার পর্যালোচক, এই বইটিকে একটি স্বচ্ছ ধারণাযুক্ত পেশাদারিত্বের প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং বইটি ডক্টরেট শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ পাঠ্য হিসেবে যথাযোগ্য মনে করেন।[২৮] পাকিস্তানে এই বইটি অধিকতর প্রশংসিত হয়।[২৯]
Reviews
There are no reviews yet.